অহল্যা চরিত্র
রামায়ণের অন্যতম একজন বিতর্কিত নারী চরিত্র, যার চরিত্রের তেজ, সংযম এবং ভক্তি আমাদেরকে বাধ্য করে তাকে সতী হিসেবে সম্মান করতে।
প্রজাপতি ব্রহ্মা যত নারী সৃষ্টি করেছিলেন সেই সমস্ত নারীদের মধ্যে সেরা অংশগুলি নিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর এই মানস কন্যা কে।
তিনি বিশ্বামিত্রের ঔরসে অপ্সরা রম্ভার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অহল্যা রূপে-গুণে ছিলেন অদ্বিতীয়া।তার রূপের প্রতি আকর্ষিত হয়ে দেবতারাও বিচলিত হত।
অহল্যার
এইহ্যান অসামান্যতার কারণে তাকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয় এবং শৈশব থেকেই
তিনি মহর্ষি গৌতম এর কাছে বড় হতে থাকেন অতঃপর পরবর্তীকালে তিনি মহর্ষি
গৌতম কেই পতি হিসেবে গ্রহণ করে নিজের সংযমী জীবনকে আরও ভক্তিমূলক করে
তোলেন।
তার
জীবন ছিল, সংযম, ভক্তি, পতি সেবা, একনিষ্ঠতা, ধৈর্য, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম,
পতির প্রতি প্রেম, বিশ্বাস, অসাধারন জ্ঞান, ন্যায়, সমর্পণ এবং অসাধারণ
সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। তার জীবনে কোনরকম কামনা বাসনা ছিল না, এই কারণেই
অল্পবয়সি নবযৌবনা হওয়া সত্বেও তিনি তার বয়স্ক পতির সাথে মানিয়ে
নিয়েছেন, কোন রকম প্রতিবাদ অথবা বিরোধিতা করেননি বরং সর্বদা পতি সেবায়
অটুট থেকেছেন এখান থেকেই দেবী অহল্যার পতিব্রতা ধর্মের দৃঢ়তা সম্পর্কে
আমরা পরিচয় পাই।
স্বামীর
প্রত্যেকটা ধর্মীয় কাজে তিনি ছিলেন তার স্বামীর ঢাল, একজন পবিত্র সংযমী
নারী তিনি,এমন কী পরিস্থিতি আসলো যে দেবী অহল্যা কে অন্যায় ভাবে
পরপুরুষের সাথে ব্যভিচারী হয়ে গমন করতে হলো!?
তিনি কেন এই অন্যায় কাজের রত হলেন?
প্রথমেই আমরা জেনেছি অহল্যার অসামান্য সৌন্দর্যের কথা তার সৌন্দর্য দেখে দেবতারাও মোহিত ছিলেন।
স্বর্গরাজ ইন্দ্র অহল্যার সৌন্দর্যে তার প্রতি আকর্ষিত হন এবং তাকে ভোগ করতে চান। অহল্যা ঋষি পত্নী এটা জানা সত্ত্বেও।
আবার
মহর্ষি গৌতম তপবল এতটাই প্রবল ছিল যে স্বর্গের ইন্দ্রত্ব পদ গ্রহণ করার
ক্ষমতা ছিল তার, এই কারণে ইন্দ্র ভয় পেয়েছিল যদি তার ইন্দ্রত্ব পদ খোয়া
যায়!?
এই
কারণে ইন্দ্র গৌতম ঋষির শক্তি খর্ব করতে তার প্রধান শক্তি তার পত্নী
অহল্যার সতিত্ব নষ্ট করেন। অবশ্য এটা সত্য এটা অস্বীকার করা যায় না যে
ইন্দ্র প্রকৃতপক্ষে অহল্যার সাথে দেহমিলনের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। নিঃসন্দেহে
ইন্দ্র নিজের কামনার দ্বারা বসবর্তি ছিলেন।
নিজের কামনা দ্বারা বশবর্তী হয়ে গৌতম ঋষির উপস্থিতিতে ইন্দ্র গৌতম ঋষির ছদ্মবেশ ধারণ করে অহল্যার কাছে যান রাতের অন্ধকারে।
স্বামীর
এই হ্যানো হঠাৎ আগমন অহল্যা কে ভাবিয়ে তোলে বটে তবে স্বামীর প্রতি
বিশ্বাস এবং ভালোবাসা তাকে পতি সেবার জন্য তরান্তরিত করে। সেই রাতের
অন্ধকারে স্বামী কামার্ত হয়ে পত্নীর কাছে এসেছেন পত্নীর ধর্ম স্বামীকে
তৃপ্ত করা।
এখানে একটা
প্রশ্ন থেকে যায় তবে কি অহল্যা এতোটাই বোকা যে স্বামীর হঠাৎ আগমনে তিনি
সন্দেহ করলেন না!? তিনি বুঝলেন না এটা তার স্বামী নয়!
হ্যাঁ তিনি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন এটা তার স্বামী নয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে হয়তো এটা তার স্বামী নাও হতে পারে।
তবে
তিনি বেশি কিছু ভাবেন নি কারণ সেই মুহূর্তে তার সামনে যেই শরীরটি
দাঁড়িয়ে ছিল সেই শরীরটাতো তার স্বামীর। নবযৌবনা এক কন্যা সংযমী হয়ে
নিজের জীবন কাটাচ্ছেন এমন অবস্থায় তার তপস্বী পতি তাকে কামার্তা করলে সে
নিঃসন্দেহে কামার্তা হয়ে উঠবে। এবং অহল্যা এই বিষয়েও বুঝতে পেরেছিলেন যে
ইনি দেবরাজ ইন্দ্র এবং স্বয়ং স্বর্গরাজ ইন্দ্র তার সাথে সঙ্গমে ইচ্ছুক এই
কথা জানতে পেরে অহল্যা একটু গর্বিত ও হয়েছিল বটে। এর প্রমাণ পাই আমরা
বাল্মিকী রামায়ণের যেখানে ইন্দ্র এবং অহল্যা সঙ্গমের পর অহল্যা মন্তব্য
করেছিল "আমি_তৃপ্ত_হলাম_সূরা_পতি"।এখান থেকে প্রমাণিত হয় অহল্যাও ইন্দ্রের সাথে একইপর্যায়ে অন্যায় করেছিল।
কিন্তু
প্রকৃতপক্ষে অহল্যা তো সূরা পতির সাথে রমন করেননি। ওই রাতে তার সামনে যে
এসে দাঁড়িয়ে ছিল তার রূপ তো হুবহু তার স্বামীর মত , তাই তিনি তার
শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন।
এই
কথা ইন্দ্র ও ভালোভাবে জানতো যে সে যদি নিজের স্বরুপে যায় তাহলে অহল্যা
কখনোই তার শয্যা সঙ্গীনি হতে রাজি হবে না। আর এটা সত্য যে ইন্দ্র নিজের
স্বয়ং রূপে আসলে অহল্যা কখনোই ইন্দ্রের প্রস্তাবে রাজি হতেন না। ইন্দ্র
অহল্যা কে রাজি করতে পেরেছেন কেবলমাত্র ইন্দ্র সেই মুহূর্তে অহল্যার
স্বামীর ছদ্মবেশে ছিলেন। এখান থেকে আমরা স্পষ্টভাবেই অহল্যা পতিব্রতা
ধর্মের উল্লেখ পেয়ে যাই। অহল্যা পাতিব্রত্য ছিল এটা এখানেই প্রমাণিত হয়ে
যায়।
তবুও
তিনি মনে মনে কামনা করেছিলেন, আকাঙ্ক্ষা রেখেছিলেন, এটাই তার অন্যায়,
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তবুও বাধা দেননি এটাই তার অন্যায়, যার কারণে তার
শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল। তবে এত বড় শাস্তি!?
গৌতম
ঋষির আগমনে তিনি যখন তপবল দ্বারা সমস্ত কিছু জানতে পারলেন তখন তিনি
ইন্দ্র কে অভিশাপ দিলেন তার শরীরে সহস্র যোনী সৃষ্টি হবে। পরবর্তীকালে
অবশ্য মহাদেবের আশীর্বাদে সেই সহস্র জোনি সহস্র নয়নে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
এবং অহল্যা অভিশাপ পায় পাষাণ হয়ে যাওয়ার।প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকের মনে হতে পারে মানুষ কিভাবে পাথর হতে পারে!?
আসলে
অহল্যার ভেতর থেকে সমস্ত অনুভূতি শক্তিগুলোকে কেড়ে নিয়ে তাকে জড়ে পরিণত
করেছিলেন ঋষি গৌতম। ওই জড় নারীতে পরিনত হয়ে অহল্যা একাগ্র মনে তপস্যা
করতে লাগলেন। ঋষি গৌতম ফ্রী আশ্রম পরিত্যাগ করলেন, একাশ এই আশ্রমে বসে
ধ্যানস্থ হলেন অহল্যা। তার ভিতরে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, সুখ-দুখ কোন
অনুভূতি না থাকায় তিনি ক্রমশ জড়ে পরিণত হলেন। এই জড় অবস্থাকেই পাষাণ এর
সাথে তুলনা করা হয়েছে। যা বর্তমানে আমরা কোমা বলে থাকি।
তাছাড়াও
অহল্যা প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বলেছিলেন সেই রাতে যিনি এসেছিলেন তিনি তো
তার স্বামীর রুপি এমন অবস্থায় অহল্যার দোষ কোথায় সেতো তার স্বামীর সাথে
রমন করেছে, ইন্দ্র তো তার স্বামীর ছদ্মবেশে এসেছিল, এতে অহল্যার দোষ কোথায়
ছিল? ইন্দ্র তার স্বামীর ছদ্মবেশে না আসলে তিনি তো কখনোই ইন্দ্রকে দেহ দান
করত না! তবুও ঋষি গৌতম তার কথা না শুনে তাকে পাষাণ হয়ে যাওয়ার অভিশাপ
দেয়।এবং অহল্যা নিজের সমস্ত অনুভূতি হারিয়ে কোমায় চলে যায় (পাষাণ হয়ে
যায়)।
এরপর
বহু বছর কেটে যায়, অযোধ্যায় আবির্ভূত হন পরমেশ্বর ভগবান। এরপর
বিশ্বামিত্রের সাথে ভগবান রামচন্দ্র তার যজ্ঞ পাহারা দেবার জন্য ভ্রমনে
বেরালে, পথে মহর্ষি গৌতম এর পরিত্যক্ত আশ্রমে তিনি পৌঁছান। অতঃপর ভগবান
অহল্যার অসার ওই পাষাণ শরীরে নিজের পদকমল স্পর্শ করিয়ে দেবী অহল্যা কে
পাষাণ মুক্ত করেন।
ভগবানের স্পর্শে অহল্যার হৃদয়ে প্রেম, ভক্তি-শ্রদ্ধা, ধৈর্য, সংযম, পবিত্রতা, সৌন্দর্য তিনি পুনরায় আবার ফিরে পান নতুনভাবে।
তিনি
এতদিন পাষাণ ছিলেন , সাধারণ মানুষ যেভাবে কোমায় থাকে ঠিক তেমন, কোমায়
থাকাকালীন তিনি নিজের হৃদয়কে তপস্যার দ্বারা শুদ্ধ করেছেন প্রায়শ্চিত্ত
করেছেন, অন্তরের শক্তিকে জাগরিত করেছেন।
এরপর
ভগবান রামচন্দ্রের আদেশে তিনি পুনরায় সামাজিক জীবনে ফিরে যান এবং নিজেকে
পুনরায় একটা সামাজিক নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ববর্তী বিভিন্ন
ঘটনাগুলোকে ভুলে গিয়ে পুনরায় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই পরিস্থিতিতে
অহল্যা যদি আত্মহত্যা করতেন অথবা সমাজ বিযুক্ত হয়ে হারিয়ে যেতেন তাহলে
কারোর কিছু বলার থাকত না। বর্তমান যুগেও বহু নারী নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
অসুরদের দ্বারা ধর্ষিত হলেও সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার সুযোগ পায় না,
সমাজ তাদের কটাক্ষ করে, ধর্ষকদের কিছু বলে না। ধর্ষিতাদের কথা শুনতে হয়
কষ্ট পেতে হয়।আত্ম লজ্জা অথবা সমাজের সমালোচনা ভীত হয়ে আতঙ্কিত হয়ে তারা
সরে যায় সমাজ থেকে বহুদূরে, বাঁচার জন্য গ্রহণ করে পতিতাবৃত্তি ও বিভিন্ন
রকমের নেশা মাদকদ্রব্য তথা বেআইনি কাজ কর্ম।
অহল্যার ক্ষেত্রেও একই রকমভাবে ছলনা হয়েছে, যদিও এক্ষেত্রে অহল্যা যথেষ্ট দোষ আছে, তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি তিনি সমাজের সামনে "সর্ব_ধর্ম_পরিত্যাগ_করে_আমার_শরণাপন্ন_হয়েযাও_আমি_তোমায়_সর্বপাপ_হতে_মুক্তকরে_মোক্ষ_প্রদানকরব"।
গীতার এই শ্লোকটি নিজের প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা প্রমাণিত করলেন। যেখানে
তার তপস্যা প্রায়শ্চিত্ত এবং অনুশোচনা থেকে শুরু করে পবিত্রতা সবকিছু তার
পূর্বের করা পাপ সম্পূর্ণ মিটিয়ে দিয়ে তাকে পুনরায় একজন অগ্নিকন্যাতে
প্রতিষ্ঠা করে যা আমাদের কাছে প্রেরণা।
অহল্যা সেই আদি মহাকাব্যের যুগের একজন নারী যে যুগের ঋষি বধুনারীরা খুব
একটা স্বাধীন ছিলেন না, তাদের মূল অস্তিত্ব ছিল তাদের স্বামী কে কেন্দ্র
করে, রক্ষণশীল সমাজ যেখানে নারীর পায়ে পরিয়ে দিয়েছিল পরাধীনতার সুকঠোর
ধর্মীয় অনুশাসনের শৃংখল,এইরকম একটা কঠোর ও কঠিন যুগে বাস করেও অহল্যা
কিন্তু সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি। বরং নিজের তপস্যার
গুণেই হোক অথবা সতীত্বের প্রভাবেই হোক, সংযম ও শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে হোক
অথবা আত্মবিশ্বাস ও গুণেই হোক কিংবা ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের কৃপা গুণেই হোক
ভুলে গেলে চলবে না তিনি কিন্তু সমাজের মূল স্রোতে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন।
শুধু
ফিরে এসেছিলেন একথা বললে ভুল হবে বলা উচিত তিনি সমাজে নিজেকে পুনরায়
প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন , নিজের ভক্তি, প্রেম, ও পবিত্রতা দ্বারা।
তাই
যুগ বিচারে তিনি তার নিজের পবিত্রতার মধ্যে দিয়ে একজন সতী নারী। তার
হৃদয়ের প্রায়শ্চিত্তের অনুভব থেকে শুরু করে পবিত্রতার পূর্নর প্রতিষ্ঠান
পর্যন্ত তার যে সতীত্বের পরিচয়, তা অসামান্য।
এমন এক অগ্নিকন্যা কে প্রণাম জানাই আমি।
-----------------------------------------------------------------------------
পোস্টটি ভাল লাগে অবশ্যই স-কলকে শেয়ার করবেন।
প্রনিপাত
সদা
সর্বদা শ্রী শ্রী রাধা ও কৃষ্ণের পাদপদ্মের কথা স্মরণ করুন, তাহলে
শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা আপনার জন্য বরাদ্দকৃত কার্য সম্পাদন করতে কোনও অসুবিধা
অনুভব করতে হবে না।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের কৃপার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে হবে।
শ্রীকৃষ্ণের পবিত্র নামটিতে অসাধারণ আধ্যাত্মিক শক্তি রয়েছে কারণ শ্রীকৃষ্ণের নাম স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের থেকে আলাদা নয় ....
ঐকান্তিক ভালবাসা এবং নিষ্ঠার সাথে এই নামগুলি জপ করুন তবেই আপনি চিণ্ময় আনন্দ অনুভব করবেন:
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ...(১০৮ বার)
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন এবং সুখী হন ...
আরো পড়ুন.....
৩.ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন মাথায় ময়ূরপালক/পুচ্ছ পরিধান করতেন??
৪.ভূমন্ডলে তুলসীর আবির্ভাব কীভাবে হলো?
৬. দ্রোপদীকে দেয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ কিছু বানী
৭. মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ
15. ভক্তি কি ?
0 Comments