ভক্তি কি ?
ভক্তির বিষয়ে শ্রীমদ্ভাগবতে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
ন সাধয়তি মাং যোগো ন সাংখ্যং ধর্ম উদ্ধব।
ন স্বাধ্যায়স্তপস্ত্যাগো যথা ভক্তির্মমোর্জিতা।।
প্রিয় উদ্ধব, আমার প্রতি আমার ঐকান্তিক ভক্তের অর্পিত সেবা আমাকে তার বশীভূত করে। অষ্টাঙ্গযোগের সাধন, সাংখ্য দর্শন পূণ্য কর্ম, বেদ অধ্যয়ন তপস্যা বা বৈরাগ্য এসব কোনটির দ্বারাই আমি তেমন বশীভূত হই না। (শ্রীমদ্ভাগবত ১১.১৪.২০)
ভক্তি হল ভগবানকে বশীভূত করার একমাত্র পন্থা, এছাড়া আর কোন উপায় নেই। শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, বন্দন, অর্চন, পাদসেবন, দাস্য, সখ্য, আত্মনিবেদন এই নয় প্রকার সাধন ভক্তি রয়েছে।
শ্রবণ, কীর্তন এবং স্মরণ হল প্রাথমিক স্তরের ভক্তি- অঙ্গ। ভগবানের নাম, বিগ্রহ, গুণ এবং লীলাসমূহই এর বিষয়বস্তু হওয়া উচিৎ। এই চারটির মধ্যে ভগবানের নাম জপ হল প্রকৃতপক্ষে ভগবদ্ভক্তির বীজ। শাস্ত্রানুসারে হরিনামই হল সকল উপাসনার মূল
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম্।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরণ্যথা।।
হরিনাম, হরিনাম, কেবল হরিনাম। কলিযুগে এছাড়া আর কোন গতি নাই, গতি নাই, গতি নাই। (বৃহন্নারদীয় পুরাণ ৩.৮.১২৬)
কলৌ শব্দটিকে এভাবে বুঝতে হবে। যদিও এমন কোন সময় ছিল না যখন ভগবানের নামই মুক্তির একমাত্র মাধ্যম ছিল না, তবুও কলিযুগে অন্যান্য মন্ত্রসমূহ এবখ আচারসমূহ দূর্বল হয়ে পড়ে। এজন্য কলিযুগের জন্য এই হরিনাম বিশেষভাবে উপযোগী। এ প্রসঙ্গে পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে,
নাম চিন্তামণি কৃষ্ণ চৈতন্য রাস বিগ্রহঃ।
পুরাণঃ শুদ্ধ নিত্যমুক্ত ভিন্নত্বন্ নামো নামিনঃ।।
এই শ্লোকের ভাষ্যে শ্রীল জীব গোস্বামী লিখেছেন,
একং এব সচ্চিদানন্দ রাসদি রূপং।
তত্ত্বং দ্বৈধাবির্ভূতং ইতি অর্থঃ।।
শ্রীকৃষ্ণ তত্ত্ব অনাদ, জ্ঞান ও সুখ হতে অভিন্ন স্বরূপ। তিনি দুইরূপে প্রকাশিত হয়েছেন। নামী অর্থাৎ, নামের অধিকারী রূপে এবং তার নামরূপে।
সকল প্রকার তত্ত্বের সার হল এই যে, শ্রীকৃষ্ণ হলেন সর্বশক্তিমান। তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী। শক্তিই হল ভগবানের অচিন্ত্য স্বরূপের ভিত্তি। প্রদর্শনকারী শক্তির মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ প্রকাশিত হয় এবং প্রার্থনার শক্তির মধ্য দিয়ে ভগবানের নাম উদ্ভাসিত হয়। কাজেই এই পবিত্র নাম অচিন্ত্য সৌভাগ্য এবং পরম উদ্দেশ্য প্রদান করে। এটিও কৃষ্ণের স্বরূপ এবং চৈতন্য রাস বিগ্রহের প্রকাশ।
এই নাম সম্পূর্ণরূপেই পূর্ণ। অন্যভাবে বলা যায়, হরিনাম জপের ক্ষেত্রে কৃষ্ণ- নারায়ণ ইত্যাদি অন্য মন্ত্র সমূহের সমন্বয় করার প্রয়োজনীয়তা নেই। যখনই কেউ পবিত্র কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করেন তখনই তার হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষ্ণ-রস উদিত হয়। হরিনাম মহামন্ত্র সম্পূর্ণরূপে পবিত্র এবং এটি কখনোই জড় বস্তুর মতো নির্জীব নয়। অচিন্ত্য ভক্তিরস দ্বারা গঠিত হরিনামই হল চৈতন্য-রস। কোন জড় জিহ্বা হতে এই নাম উৎপন্ন হতে পারে না। যিনি হরিনামের রসাস্বাদন করেছেন কেবল তিনিই এই বর্ণণা বুঝতে পারেন। যারা মনে করেন হরিনাম কোন নির্জীব বস্তু বা জাগতিক কোন বিষয়, তারা কখনোই এই বর্ণণা বুঝতে পারবেন না বা এই ব্যাখ্যার দ্বারা সন্তুষ্টি হবেন না।
কেউ বলতে পারেন, আমরা যে নাম উচ্চারণ করি তা জাগতিক অক্ষরসমূহ দ্বারা তৈরি। তাহলে কীভাবে এটা বলা যেতে পারে যে হরিনাম কোন জাগতিক বিষয় নয়? শ্রীল রূপ গোস্বামী এবিষয়ে আলোকপাত করেছেন এভাবে,
অতঃ শ্রীকৃষ্ণ নামাদি ন ভবেদ গৃহয়ম্ ইন্দ্রিয়ঃ।
সেবোন্মুখে হি জিহ্বাদৌ স্বয়ম এব স্ফূর্তি আদঃ।।
(ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ১.২.২৩৪)
অর্থাৎ জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা কেবল জাগতিক বিষয়সমূহকেই উপলব্ধি করা যায়। ভগবানের অপ্রাকৃত নাম চিন্ময়। কাজেই, জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কখনোই সেটাকে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। কিন্তু যখন জিহ্বার দ্বারা মহামন্ত্র উচ্চারণ করা হয় তখন সেই পরম সত্য স্বয়ং জিহ্বায় অবস্থান পূর্বক নৃত্য করতে থাকে। তখন ভক্তের মধ্যে দিব্য রসসমূহ উদ্ভূত হয়। তিনি প্রেমানন্দে হাসেন, কাঁদেন, বিলাপ করেন বা নৃত্য করেন। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণ নাম সুধা জিহ্বায় বিস্তৃত হয়। ভগবানের নাম কোন জড় দেহের জিহ্বা হতে উৎপন্ন নয়।
সাধনার প্রারম্ভে যখন হরিনাম জপ করা হয়, তখন সেটি অজ্ঞতা, অনর্থ, জড় বাসনা ইত্যাদি ভক্তির প্রতিকূল বিষয় দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। তখন একে বকা হয় নামাভাস। এটি হরিনামের পূর্ণ স্বরূপ নয়। বহুবার এমন দেখা গিয়েছে যে, নিয়মিত নামভাস অভ্যাসের ফলে কেউ উৎকর্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে চিন্ময় হরিনামে চিন্ময় রস আস্বাদন করেছেন। বাল্মিকী মুনি এবং অজামিলের জীবনী এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
বিভিন্ন প্রকার অপরাধ করার ফলে জীব হরিনামের রসাস্বাদন করতে পারেনা। যারা অপরাধ শূণ্য হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চিন্ময় নাম “শ্রীহরি” জপ করেন তাদের হৃদয়ে সজল রসের জলাধার উদ্ভাসিত হয়। তাদের হমদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়, তাদের আঁখি হতে অশ্রু ঝরে, সাত্ত্বিক বিকার সৃষ্টি হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে এই কথা বলা হয়েছে,
তদশ্মসারং হৃদয়ং বতেদং
যদগৃহ্যমানৈর্হরিনামধেয়ৈঃ।
ন বিক্রিয়েতাথ যদা বিকারো
নেত্রে জলং গাত্ররুহেষ হর্ষঃ।।
হরিনাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও যার হৃদয় দ্রবীভূত হয় না, নেত্র অশ্রুপূর্ণ হয় না এবং লোমসমূহ আনন্দে পুলকিত হয় না তার হৃদয় অবশ্যই ইস্পাতের আবরণে আচ্ছাদিত। (শ্রীমদ্ভাগবত ২.৩.২৪)
- হরেকৃষ্ণ
সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
আরো পড়ুন.....
আমাদের সমস্ত দুঃখের কারণ অজ্ঞনতা। সুতরাং জানতে হলে পড়তে হবে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার আলোকে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রশ্ন-উত্তরে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
একাদশী ব্রত পালনের তাৎপর্য ও নিয়মাবলি এবং বছরের সব একাদশির মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
পূজা-পার্বনের তাৎপর্য ও মহিমা সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
আরতি-উপসনা-প্রার্থনা সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
সনাতন পারমার্থিক জ্ঞান সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
গুরুতত্ত্ব সম্পর্কে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন.......
অডিও ভিডিও ভজন-আরতি-নামকীর্তন শুনুন এবং ডাউনলোড করুন নিচের লিংকে ক্লিক করে...
আরো পড়ুন.....
৩.ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন মাথায় ময়ূরপালক/পুচ্ছ পরিধান করতেন??
৪.ভূমন্ডলে তুলসীর আবির্ভাব কীভাবে হলো?
৬. দ্রোপদীকে দেয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ কিছু বানী
৭. মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ
0 Comments