আজ #শুভ #ভাদ্র #পূর্ণিমা তথা #শ্রীমদ্ভাগবত #আবির্ভাব তিথি। ৫,১০২ বছর পূর্বে আজকের এই দিনে পরমহংস চূড়ামনি শ্রীল শুকদেব গোস্বামীপাদ পরীক্ষিত মহারাজকে ভাগবত কথামৃত শ্রবণ করিয়েছিলেন।
তাই আসুন আজকের এই দিনে আমরা সকলে সেই শ্রীমদ্ভাগবত কথামৃত শ্রবণ করি, যা শ্রবণে হৃদয় ও শ্রবণেন্দ্রিয় তৃপ্ত হয় এবং যা একমাত্র জন্ম মৃত্যুর প্রবাহ নিবৃত্ত করতে পারে।
অমল পুরান (শ্রীমদ্ভাগবত),
প্রথম স্কন্ধ, প্রথম অধ্যায়- ঋষিদের প্রশ্ন!
হে বসুদেব তনয় শ্রীকৃষ্ণ, হে সর্বব্যাপ্ত পরমেশ্বর ভগবান, আমি আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। আমি শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, কেননা তিনি হচ্ছেন প্রকাশিত ব্রহ্মান্ড সমূহের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের পরম কারণ।
তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সব কিছু সম্বন্ধে অবগত এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, কেননা তাঁর অতীত আর কোন কারণ নাই। তিনিই আদি কবি ব্রহ্মার হৃদয়ে সর্বপ্রথম বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেছিলেন।
তাঁর দ্বারা মহান ঋষিরা এবং স্বর্গের দেবতারাও মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঠিক যেভাবে মোহাচ্ছন্ন হলে আগুনে জল দর্শন হয়, অথবা জলে মাটি দর্শন হয়। তাঁরই প্রভাবে জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের মাধ্যমে জড় জগৎ সাময়িকভাবে প্রকাশিত হয় এবং তা অলীক হলেও সত্যবৎ প্রতিভাত হয়।
তাই আমি সেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করি, তিনি জড় জগতের মোহ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত তাঁর ধামে নিত্যকাল বিরাজ করেন। আমি তাঁর ধ্যান করি, কেননা তিনিই হচ্ছেন পরম সত্য।
জড় বাসনাযুক্ত সব রকমের ধর্ম সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে এই ভাগবত পুরাণ পরম সত্যকে প্রকাশ করেছে যা কেবল সর্বতোভাবে নির্মৎসর ভক্তরাই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। পরম সত্য হচ্ছে পরম মঙ্গলময় বাস্তব বস্তু; সেই সত্যকে জানতে পারলে ত্রিতাপ দুঃখ সমূলে উৎপাটিত হয়।
মহামুনি বেদব্যাস (উপলব্ধির পরিপক্ক অবস্থায়) এই শ্রীমদ্ভাগবত রচনা করেছেন এবং ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান হৃদয়াঙ্গম করতে এই গ্রন্থটিই যথেষ্ট। সুতরাং অন্য কোন শাস্ত্রগ্রন্থের আর কি প্রয়োজন ?
কেউ যখন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে এবং একাগ্রতা সহকারে এই ভাগবতের বাণী শ্রবণ করেন, তখন তাঁর হৃদয়ে ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান প্রকাশিত হয়।
হে বিচক্ষণ এবং চিন্তাশীল মানুষ, কল্পবৃক্ষরূপী বৈদিক শাস্ত্রের অত্যন্ত সুপক্ক ফল শ্রীমদ্ভাগবত আস্বাদন করুন। তা শ্রীল শুকদেব গোস্বামীর শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল। তাই এই ফলটি আরও অধিক উপাদেয় হয়েছে, যদিও এই অমৃতময় রস মুক্ত পুরুষেরা পর্যন্ত আস্বাদন করে থাকেন।
এক সময় শৌণক আদি ঋষিরা পরমেশ্বর ভগবান এবং তাঁর ভক্তদের প্রীতি সাধনের জন্য বিষ্ণু-তীর্থ নৈমিষারণ্যে সহস্র বর্ষব্যাপী এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন।
একদিন প্রাতঃকালে সেই শৌনকাদি ঋষিরা হুতাগ্নিতে আহুতি প্রদান করে সমাদৃত আসনে উপবিষ্ট শ্রীল সূত গোস্বামীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন– “ হে পরম শ্রদ্ধেয় সূত গোস্বামী, আপনি সম্পূর্ণরূপে নিষ্পাপ।
আপনি মহাভারত আদি ইতিহাস সহ অষ্টাদশ পুরান এবং সমস্ত ধর্মশাস্ত্র সদ্গুরুর কাছে অধ্যয়ন করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তা আপনি ব্যাখ্যাও করেছেন। ”
“ হে সর্বপ্রবীণ বেদান্তবিদ সূত গোস্বামী, আপনি ভগবানের অবতার ব্যাসদেবের জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন, এবং যে সমস্ত ঋষিরা ভৌতিক এবং আধিভৌতিক জ্ঞান পূর্ণরূপে লাভ করেছেন তাদের কাছ থেকেও আপনি জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছেন।
যেহেতু আপনি শ্রদ্ধাশীল এবং বিনীত, তাই আপনার গুরুদেবেরা বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেছেন। কেন না, স্নিগ্ধ স্বভাবসম্পন্ন অর্থাৎ প্রীতিশীল শিষ্যের কাছেই গুরুবর্গ অতি নিগূঢ় রহস্য ব্যক্ত করেন।
হে আয়ুষ্মান ! আপনি জনসাধারণের পরম মঙ্গল কিভাবে সাধিত হয়, তা সহজবোধ্যভাবে আমাদের কাছে শোনান। ”
“হে মহাজ্ঞানী, এই কলিযুগের মানুষেরা প্রায় সকলেই অল্পায়ু। তারা কলহপ্রিয়, অলস, মন্দগতি, ভাগ্যহীন এবং সর্বোপরি তারা নিরন্তর রোগাদির দ্বারা উপদ্রুত। বহুবিদ শাস্ত্র রয়েছে এবং সেই সমস্ত শাস্ত্রে নানা রকমের কর্তব্য-কর্মের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা বহু বছর ধরে বিভাগক্রমে পাঠ করার ফলে কেবল জানতে পারা যায়।
তাই হে মহর্ষি, দয়া করে আপনি সেই সমস্ত শাস্ত্রের সারমর্ম সমস্ত জীবের মঙ্গলের জন্য বিশ্লেষণ করে শোনান, যাতে তাদের হৃদয় সম্পূর্ণভাবে সুপ্রসন্ন
হতে পারে। ”
“ হে সূত গোস্বামী ! আপনার সর্ববিধ মঙ্গল হোক। আপনিও অবগত আছেন যে কি উদ্দেশ্যে পরমেশ্বর ভগবান বসুদেব-পত্নী দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যাঁর অবতার এবং আবির্ভাব সমস্ত জীবের মঙ্গল এবং সমৃদ্ধির জন্য হয়ে থাকে, আমরা সেই বাসুদেবের লীলাসমূহ শ্রবণ করতে অভিলাষী। আপনি অনুগ্রহ করে গুরু-পরম্পরায় লব্ধ সেই জ্ঞান আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করুন, কেন না তা শ্রবণ ও কীর্তনে উভয়েরই কল্যাণ সাধিত হয়। ”
“জন্ম-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর আবর্তে আবদ্ধ মানুষ বিবশ হয়েও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নাম উচ্চারণ করতে করতে অচিরেই সেই সংসারচক্র থেকে মুক্ত হয়, সেই নামে স্বয়ং মহাকালও ভীত হন।
হে সূত গোস্বামী, যে সমস্ত মহর্ষিরা সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গ-প্রভাবে অর্থাৎ দর্শন মাত্রই জীব পবিত্র হয়, কিন্তু সুরধুনী গঙ্গার জল সাক্ষাৎ সেবা অর্থাৎ স্পর্শন, অবগাহন আদি করার পরেই কেবল মানুষকে পবিত্র করে।
কলিযুগের পাপ-পঙ্কিল অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষী এমন কে আছে যে পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত মহিমা শ্রবণ করতে অনিচ্ছুক ?
পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত কার্যকলাপ অত্যন্ত মহৎ ও উদার এবং নারদ আদি মহান ঋষিরা তা কীর্তন করেন। তা শ্রবণ করার জন্য আমরা অত্যন্ত আকুল হয়েছি, দয়া করে আপনি বিভিন্ন অবতারে তাঁর বিভিন্ন লীলাবিলাসের কথা আমাদের বলুন। ”
“হে মহাজ্ঞানী সূত গোস্বামী, দয়া করে আপনি আমাদের কাছে পরমেশ্বর ভগবানের অসংখ্য অবতারের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের কথা বর্ণনা করুন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই পরম মঙ্গলময় লীলাবিলাস সম্পাদিত হয় তাঁর চিৎ-শক্তি যোগমায়ার দ্বারা। উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত হন যে পরমেশ্বর ভগবান, তার অপ্রাকৃত লীলাকথা যতই আমরা শ্রবণ করি না কেন, আমাদের তৃপ্তি হবে না।
যাঁরা তাঁর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার অপ্রাকৃত রস আস্বাদন করেছেন তাঁরা নিরন্তর তাঁর লীলাবিলাসের রস আস্বাদন করেন। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে মনুষ্যরূপ লীলাবিলাস করেছেন, এবং এইভাবে তাঁর স্বরূপ গোপন রেখে তিনি বহু অলৌকিক কার্যকলাপ সম্পাদন করেছেন।
কলিযুগের আগমন হয়েছে জেনে আমরা এই বৈষ্ণব-ক্ষেত্রে নৈমিষারণ্যে দীর্ঘকাল ব্যাপী যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য এসে উপস্থিত হয়েছি, এখন আমাদের হরিকথা শ্রবণের অবসর লাভ হয়েছে।
আমরা মানুষের সদ্গুন অপহরণকারী কলিকাল-রূপ দুর্লঙ্ঘ সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে ইচ্ছুক। সমুদ্রের পরপারে গমন করতে ইচ্ছুক মানুষের কাছে কর্ণধার সদৃশ আপনাকে বিধাতাই আমাদের কাছে পাঠিয়ে আপনার দর্শন লাভ ঘটিয়েছেন।
পরম ব্রহ্ম যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সম্প্রতি তাঁর নিত্য ধামে অন্তর্ধান রূপ অপ্রকট লীলায় প্রবেশ করলে সনাতন ধর্ম কার শরণাপন্ন হয়েছে, তা আমাদের বলুন। ”
0 Comments