চার যুগ-সত্য,ত্রেতা,দ্বাপর ও কলির সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ:-
চার যুগের সময় পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ:-
★ ১.সত্য যুগ
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সত্য যুগ হলো, চার যুগের প্রথম যুগ। অন্য যুগ গুলো হলো ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ।
মৎস্য অবতার
বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে রবিবারে সত্যযুগের উৎপত্তি। এই যুগের আয়ু বা পরিমাণ ছিল ১৭,২৮,০০০ বছর।এই যুগে ভগবান ৪ টি রূপে অবতার নিয়েছিলেন । 1. মৎস্য (মাছ),2.কুর্ম (কচ্ছপ),3.বরাহ (শুকর),4. নৃসিংহ (সংস্কৃত: नरसिंह, বানানান্তরে নরসিংহ)(মানুষ ও সিংহের সমন্বিত রূপ)।
কুর্ম অবতার
বরাহ অবতার
এই যুগের প্রমুখ শাসক ছিলেন ছয় জন। বলি, বেণ, মান্ধাতা, পুরোরবা, ধুন্ধুমার, কাত্তাবীর্য্য অর্জুন। এই যুগে শুধু পুণ্য ছিল, পাপ ছিল না। প্রাণ ছিল মজ্জায়। মৃত্যু ছিল ইচ্ছাধীন। এই যুগে সোনার পাত্র ব্যবহার করা হত। । এই যুগে মানুষের সমস্ত ইচ্ছাই পূর্ণ হত। তীর্থ ছিল পুষ্কর তীর্থ।
নৃসিংহ অবতার
★২ ত্রেতা যুগ:-
ত্রেতা যুগ হলো হিন্দুধর্ম অনুযায়ী, চার যুগের দ্বিতীয় যুগ। কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের নবমী তিথিতে সোমবারে ত্রেতা যুগের উৎপত্তি। এই যুগের আয়ু বা পরিমাণ ছিল ১২,৯৬,০০০ বছর। এই যুগে পালনকর্তা বিষ্ণুর তিন অবতার যথাক্রমে বামন, পরশুরাম এবং রাম।
বামন অবতার
পরশুরাম অবতার
রাম অবতার
এই যুগে পুণ্য ছিল তিন ভাগ, পাপ এক ভাগ। এই যুগে সূর্য বংশের প্রমুখ শাসকরা হলেন- ব্রহ্ম, মরীচি, কাশ্যপ, সাবর্ণিক, মনু, ধনু, সুষেণ, হরিদাস, যৌবনাশ্ব, মুচুকুন্দ, শতবাহু, বেন, পৃত্থু, ইক্ষাকু, দ্যোতকর, কৎসর্প, শ্রেষ্ঠধর, ককুৎস্থ, শতঞ্জীব, দণ্ড, হরিষ, বিজয়, হরিশচন্দ্র, রোহিতাশ্ব, মৃত্যুঞ্জয়, মহাপদ্ম, ত্রিশঙ্কু, উচ্চাঙ্গদ, মরুৎ, অনরণ্য, বিকর্ণবাহু, সগর, অংশুমান, অসমঞ্জ, ভগীরথ, অশ্বঞ্জয়, মণি দীলিপ, রঘু, অজ, দশরথ, শ্রীরাম, লব, কুশ। এই যুগে প্রাণ ছিল অস্থিতে। রূপার পাত্র ব্যবহার করা হত।এই যুগে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করতে যজ্ঞ করতে হত। তীর্থ ছিল নৈমিষ অরণ্য।
★৩ দ্বাপর যুগ
শ্রীকৃষ্ণ অবতার
দ্বাপর যুগ হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের তৃতীয় যুগ।ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপর যুগের উৎপত্তি। এই যুগের আয়ু বা পরিমাণ ছিল ৮,৬৪,০০০ বছর। এই যুগে পালনকর্তা বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণ ।এই ভগবান শ্রী কৃষ্ণই হলেন ধরাতলে অবতীর্ণ শ্রী হরি বিষ্ণুর অবতার গুলির মধ্যে ১৬ কলাতে পূর্ণ ও পরম ব্রহ্মের পূর্ণ অবতার।
এই যুগে পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক।এই যুগের প্রমুখ শাসক ছিলেন -শাল্ব, বিরাট, হংসধ্বজ, কুশধ্বজ, ময়ুরধ্বজ, বভ্রুবাহন, রুক্ষাঙ্গদ, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, পরিক্ষিৎ, জনমেজয়, বিষকসেন, শিশুপাল, জরাসন্ধ, উগ্রসেন, কংস।এই যুগে প্রাণ ছিল রক্তে। তামার পাত্র ব্যবহার করা হত।এই যুগে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করতে কঠিন যজ্ঞ করতে হত। তীর্থ ছিল কুরুক্ষেত্র।
রাজা পরীক্ষিতের মুকুটে কলি যুগের প্রবেশ। এরপর থেকেই কলির প্রভাবে বাড়তে লাগল রাজা পরীক্ষিতের দুর্বুদ্ধি।
★৪ কলি যুগ
কলি যুগ , আক্ষরিকভাবে “কলির যুগ”, বা “পাপের যুগ”) হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, চার যুগের শেষ যুগ। অন্য যুগ গুলো হলো সত্য যুগ,ত্রেতা যুগ, ও দ্বাপর যুগ।
মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পুর্ণিমা তিথিতে শুক্রবারে কলিযুগের উৎপত্তি। এই যুগের আয়ু বা পরিমাণ ৪,৩২,০০০ বছর। কলি যুগে পুণ্য এক ভাগ, পাপ তিন ভাগ। অবতার কল্কি। মানুষের আয়ু প্রায় একশ বছর । মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্য নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত । প্রাণ অন্নে। তীর্থ গঙ্গা। এই যুগে সব পাত্র ব্যবহার করা হয়। ধর্ম সংকোচিত। মানুষ তপস্যাহীন, সত্য থেকে দূরে অবস্থানরত। রাজনীতি কুটিল। শাসক ধনলোভী। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রহীন। পুরুষ স্ত্রীর অনুগত। পাপে অনুরক্ত। সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি। দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি। এই যুগে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব ।
কলি যুগের সূচনা।
বেদব্যাস রচিত বিষ্ণু পুরানে বলা হয়েছে যে কৃষ্ণের পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গারোহণের সময় থেকে পৃথিবীতে কলি যুগের সূচনা হয়েছে।
কলি যুগের সময় পরিমাণ:-
মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে মানুষের এক বছরে দেবতাদের এক দিবারাত্র হয়। উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ন তাদের রাত। ৪,০০০ (চার সহস্র) দৈবপরিমাণ বছরে সত্য বা কৃত যুগ হয় এবং ওই যুগের আগে ৪০০(চার শত) বছর সন্ধ্যা ও পরে ৪০০ বছর সন্ধ্যাংশ হয়। পরবর্তী যুগগুলিতে (ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি) যুগের পরিমাণ ১,০০০(এক হাজার) বছর করে এবং সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ১০০(এক শত) বছর করে কমে যায়। এই হিসাবে ১০০০ দৈব বছরে কলিযুগ হয় এবং এর সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ ১০০ বছর হয়; অর্থাৎ ১২০০ দৈব বছরে কলি যুগ সম্পূর্ণ হয় সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ সহ । ১ দৈববছর যদি ৩৬০ দৈব দিনে হয় তবে কলিযুগ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে ১২০০x৩৬০=৪,৩২,০০০ মনুষ্য বা সৌর বছর।
সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ;-(প্রতিযুগে “সন্ধ্যা” ও “সন্ধ্যাংশ” থাকে।। যুগ আরম্ভ হইবার অব্যবহিত পূৰ্ব্বকালকে “সন্ধ্যা” বলে। দুই যুগের. সন্ধিকেই “সন্ধ্যা” বলে। দিবসের যেরূপ প্রাতঃসন্ধ্যা ও সয়ংসন্ধ্যা,. যুগের সেইরূপ সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ। শেষ অংশকে “সন্ধ্যাংশ” বলে।)
মানুষের আয়ুকাল
মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে সত্যযুগে মানুষের আয়ু ছিল ৪০০ (চার শত) বছর। পরবর্তী ৩ যুগে ১০০ বছর করে পরমায়ু কমে যায়। এই হিসেবে কলি যুগে মানুষের পরমায়ু ১০০ বছর।
কলি যুগের লক্ষণ
বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মা সত্যযুগে সমস্ত সৃষ্টিকর্ম করেন এবং কলিতে সমস্ত সৃষ্টি উপসংহার করেন।
মনু সংহিতায় বলা হয়েছে যে সত্যযুগে তপস্যা, ত্রেতায়ুগে জ্ঞান, দ্বাপরয়ুগে যজ্ঞ এবং কলিতে দানই প্রধান হবে ।
কলিযুগের অন্তে মানে শেষের দিকে কলিযুগের অবতার রুপে অবতারিত হবেন ভগবান কল্কি এবং তাঁর স্ত্রী হবেন মাতা বৈষ্ণো দেবী (বৈষ্ণবী)।ভগবান কল্কি জন্ম নিবেন, শম্ভল নামক গ্রামে বিষ্ণুযশ নামক ব্রাহ্মণের বাড়িতে মাতা সুমতির গর্ভে, তিনি চতুর্ভুজ মুর্তি ত্যাগ করে মনুষ্য রুপে অবতারিত ( অবতারণ করবেন) হবেন।
কল্কি হবেন বিষ্ণুযশ-সুমতির চতুর্থ সন্তান । বিষ্ণুযশ-সুমতির প্রথম তিন সন্তানের নাম হবে যথাক্রমে কবি, প্রাজ্ঞ আর সুমন্তক ।
কল্কি অবতার
কলিযুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ:-

কলিযুগের শাসকের বৈশিষ্ট্যসমূহ:-
ঋষি মার্কণ্ডেয়র মতে কলিযুগের শাসকরা ন্যায়বিরূদ্ধ,নিয়মবিরূদ্ধ,নিয়মশৃঙ্খলাহীন এবং অযৌক্তিক হয়ে উঠবেন এবং তারা অন্যায়ভাবে কর আদায় করবেন। শাসকেরা তাদের প্রজাদের রক্ষা করার দায়িত্ব এবং আধ্যাত্মিকতাকে বজায় রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না এছাড়া তাদের মধ্যে অনেকেই সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্য পরায়ণ হবেন না। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ লোক নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যক্তি, সমাজ এবং বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবেন।
কলিযুগের মানুষের বৈশিষ্ট্যসমূহ:-





কলিযুগের মানুষেরা বেদ অধ্যয়ন করবেন না। মানুষ অশাস্ত্রীয় তপস্যা করবেন ।









অধিকাংশ নারীরা সাধারনতঃ স্বেচ্ছাচারিণী ও বিলাস উপকরণে অতিশয় অনুরাগিণী হবেন । স্ত্রীলোকরা নিতান্তই লোভী হবেন , বহু ভোজনশীল হবেন । কলিযুগে অধিকাংশ স্ত্রীরা পতিকে অবহেলা করবেন এবং নিজের দেহ পোষণে ব্যস্ত থাকবেন এবং নিরন্তন কঠোর ও মিথ্যা বাক্য বলবেন। কলিযুগে সুন্দরী স্ত্রীরা যার তার সাথে বন্ধুত্ব করবেন ।

কলিযুগের মানুষ একটি দেশ থেকে কাজের এবং খাদ্য অনুসন্ধানের জন্য অন্য দেশে চলে যাবেন।
কলিযুগের মানব সম্পর্কে ঋষি মার্কণ্ডেয়র বক্তব্য :-







ধর্মগ্রন্থ অনুসারে দান করাই হবে কলিযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম । রামায়ণের শেষ খন্ডে লেখা আছে ভগবান শ্রী রামচন্দ্র মর্তলোক থেকে স্বর্গলোক যাবার সময় বজরংবলী হনুমান কে বলেছিলেন কলিযুগে হরিনাম সংকীর্তন ই হবে মোক্ষ প্রাপ্তির উপায়। চৈতন্য মহাপ্রভুও সেই একই কথা বলেছেন ।
0 Comments